শামীমা বেগম: সাম্প্রতিক সময়ে নতুন এক আতঙ্কের নাম মব জাস্টিস। সংঘবদ্ধ কিছু মানুষের নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতাকে অপরাধবিজ্ঞানের ভাষায় ‘মব জাস্টিস’ বলা হয়। দেশ ও পরিস্থিতিভেদে মব জাস্টিসের কারণ ভিন্ন হতে পারে। তবে এর পেছনে মূল একটি কারণ হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো এবং আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থাকে দুর্বল করে দেওয়া।
দেশে মব জাস্টিস নতুন নয়, আগে সন্দেহভাজন চোর- ডাকাতদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনা বেশি দেখা গেলেও, এখন শিক্ষক, সাধারণ পথচারী, এমনকি বিদেশিরাও গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন। মানুষের ভেতর ভয়, ক্ষোভ ও অনাস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, কেউ একজন অপরাধী বলে সন্দেহের বিষয়টি উঠলেই মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজিত কিছু মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এর ফলে নিরপরাধ অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন, আহত হচ্ছেন, সামাজিক হিংস্রতার শিকার হচ্ছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বৈশ্বিক মোষনা অনুযায়ী, মব জাস্টিসের কারণে মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন হয়। মোষণার ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালের অধীনে সবার সমতার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আর ঘোষণার ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যাক্তির অধিকার- তাকে যেন নিরপরাধ বলে বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে বিচারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে, ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর মব জাস্টিস উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকে। যখন তখন কারও বাড়ি ঢুকে লুটপাটসহ কাউকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। কোথাও আবার কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি কাউকে জুতার মালা পরিয়ে কান ধরে উঠবস করানো হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে- যা উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছেন রাজনীতিবিদ, পুলিশ, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সর্বত্র এক ধরনের ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে: যা সভ্য সমাজে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে- কেন এ ধরনের প্রবণতা সমাজে বেড়ে চলেছে? মানুষ কেনই বা তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে? যদিও বেশিরভাগ মানুষ এ প্রশ্নের উত্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে নানামুখী শৈমিল্যকেই দায়ী করে থাকে।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৪ মার্চ ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে ইরানের দুই নাগরিককে মারধর করে কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল জনতা। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য, ইরানের এ দুই নাগরিক ছিনতাইকারী ছিলেন না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারা। এক পর্যায়ে ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে তাদের মারধর করা হয়। ৩ মার্চ রাতে নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় মাসকা বাজারসংলগ্ন শাহ নেওয়াজ ফকিরের মাজারে ওরস আয়োজন কেন্দ্র করে ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে ভাঙচুর করা হয়। সেখানে গানবাজনা ও মাদক সেবন করা হবে, এমন অভিযোগ তোলা হয়। এর আগে ১ মার্চ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে রহিম শাহ বাবা ভান্ডারির মাজারে ওরসের নামে গানবাজনা, মাদক সেবনের অভিযোগ তুলে ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলার কারণে ২৯ জানুয়ারি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নারীদের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ বাতিল করা হয়। আগের দিন একদল মানুষ মিছিল নিয়ে এসে খেলার মাঠের টিনের বেড়া ভাঙচুর করে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর হিসাবে, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সাত মাসে গনপিটুনিতে অন্তত ১২৯ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৭৪ জন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে। গত বছর এ ধরনের ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত হয়েছে। এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত ছয় মাসে পুলিশের ওপর ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও হামলা করে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। বেশিরভাগ ঘটনা ঘটানো হয়েছে উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘাবন্ধ আক্রমণে বা ‘মব’ তৈরি করে। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মব তৈরি করে হামলাগুলো করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও মব তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন। এ মব তৈরি করে শুধু পুলিশের ওপরই হামলা হচ্ছে তা নয়, বরং কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষের ওপরও হামল্য বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
বর্তমানে হামলার ঘটনায় পুলিশের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় কোনো সদস্য আক্রান্ত হলে আরও কঠোর হওয়ার চিন্তা করছে পুলিশ। সংস্থাটির সদর দপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা হলো, আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটলে প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করতে হবে। ইতোমধ্যে কিছু মটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এ মামলা হয়েছে। এর বাইরে হামলাকারীদের প্রিভেনটিভ ডিটেনশন বা প্রতিরোধমূলক আটক করার চিন্তাও করছে পুলিশ; যা একটি ভালো দিক বলে মনে হচ্ছে।
অপরাধ-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীরা পুলিশকে ভয় না পেলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে ছিনতাইকারী, মাদক কারবারিরাও যখন মব তৈরি করে পুলিশের ওপর হামলা করে, তখন এটি উদ্বেগের বিষয়। নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আইন প্রয়োগে পুলিশকে সহযোগিতা করা।
মব জাস্টিস বন্ধে সরকারের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের আরও কঠোর হতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুরো শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক পাড়া-মহল্লায় টহল বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরাসরি মাঠে থেকে পুরো বিষয় মনিটরিং করা প্রয়োজন। কে কোন দলের এসব বিবেচনায় না নিয়ে অপরাধীকে ধরতে হবে। তাহলে সমাজ থেকে মবের মতো ঘটনা কমে আসবে।
মব জাস্টিস প্রতিরোধে সরকারকে অবশ্যই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কঠোর হতে হবে। গণপিটুনিসহ সকল প্রকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মন জাস্টিস প্রতিরোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ইত্যাদির উদ্যোগ নিতে হবে। দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সৎ, দক্ষ, আইনান্ত নিয়েগ করতে হবে। মব জাস্টিসের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজমাধ্যম ও অন্যান্য মাধ্যমে গুজব ছড়ানো বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সহিংসতা পরিহার করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কমানো গেলে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসবে। নাগরিক হিসেবে আমাদের সমাজমাধ্যম ব্যবহারে দায়িত্বশীল হতে হবে। উস্কানিমূলক পোস্ট, ছবি, ভিডিও শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।